কবি নজরুল ইসলাম রচিত কিছু কীর্তন ও ভজন গান | Bhajan and Kirton Song writen by Najrul Islam

কবি নজরুল ইসলাম রচিত কিছু কীর্তন ও ভজন গান

Bhajan and Kirton Song writen by Najrul Islam

আমি কি সুখে

ওরে নীল যমুনার জল

কেন প্রেম-যমুনা

গাহ নাম অবিরাম

গোঠের রাখাল

জগতের নাথ কর পার হে

জাগো জাগো শঙ্খ চক্র

ফুটিল মানস

বনে যায় আনন্দ-দুলাল

বিজন গোঠে কে রাখাল

ব্রজ–গোপী খেলে হোরি

মম মধুর মিনতি

হে গোবিন্দ

হে মাধব

হারিয়ে গেছে ব্রজের কানাই

সখী সে হরি কেমন বল

সখী সাজায়ে রাখ লো

সখী আমি না হয়

শ্যামসুন্দর গিরিধারী

 

আমি কি সুখে

আমি কি সুখে লো গৃহে রব
সখী গো,
আমার শ্যাম হলো যদি যোগী
ওলো সখী আমিও যোগিনী হব।

আমি যোগিনী হব,
শ্যাম যে তরুর তলে বসিবে লো ধ্যানে
সেথা অঞ্চল পাতি’ রব,
আমার বঁধুর পথের ধূলি হব
আমায় চলে যেতে দলে যাবে
সেই সুখে লো ধূলি হব।

সখী গো,
আমি আমার সুখের গোধূলি বেলার
রঙে রঙে তারে রাঙাইব,
তার গেরুয়া রাঙা বসন হয়ে
জড়াইয়া রব দিবস যামী।

সখী গো,
সখী আমার কঠিন এ রূপ হবে
রুদ্রাক্ষেরই মালা,
তার মালা হয়ে ভুলব আমার
পোড়া প্রাণের জ্বালা।
আমার এ দেহ পোড়ায়ে
হইব চিতা ছাই,
মাখিবে যোগী মোর
পুড়িব সেই আশায়।
পোড়ার কি আর বাকি আছে,
আমার শ্যাম গেছে যোগী হয়ে
ছায়া শুধু পড়ে আছে।

ওরে নীল যমুনার জল

ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।
আমি বহু আশায় বুক বেঁধে যে এলাম,
এলাম ব্রজ ধাম।

তোর কোন কূলে, কোন বনের মাঝে
আমার কানুর বেণু বাজে,
আমি কোথায় গেলে শুনতে পাব
রাধা রাধা নাম।

আমি শুধাই ব্রজের ঘরে ঘরে
কৃষ্ণ কোথায় বল,
কেন কেউ কহেনা কথা
হেরি সবার চোখে জল।

বল রে আমার শ্যামল কোথায়
কোন মথুরায় কোন দ্বারকায়,
বাজে বৃন্দাবনের কোন পথে তাঁর
নূপুর অবিরাম।

কেন প্রেম-যমুনা

কেন প্রেম-যমুনা আজি হলো অধীর,
দোলে টলমল রহে না স্থির।

মানে না বারণ উথলে বারি
ভাসালো কুল-লাজ রুধিতে নারি,
সখী ডাক শুনেছে সে কার মুরলীর।

গাহ নাম অবিরাম

গাহ নাম অবিরাম, কৃষ্ণনাম কৃষ্ণনাম,
মহাকাল যে নামের করেন প্রাণায়াম।

যে নামের গুণে কংস-কারার খোলে দ্বার
বসুদেব যে নামে যমুনা হলো পার,
যে নাম মায়ায় হলো তীর্থ ব্রজধাম
গাহ নাম অবিরাম, কৃষ্ণনাম কৃষ্ণনাম।

দেবকীর বুকের পাষাণদলে
যে নাম দোলে যশোদার কোলে,
যে নাম লয়ে কাঁদে রাই রাসময়ী
কুরুক্ষেত্র যে নামে হলো পান্ডব জয়ী,
গোলোকের নারায়ণ ভূলোকের রাধাশ্যাম
গাহ নাম অবিরাম, কৃষ্ণনাম কৃষ্ণনাম।

গোঠের রাখাল

গোঠের রাখাল, বলে দে রে কোথায় বৃন্দাবন।
যথা, রাখাল–রাজা গোপাল আমার খেলে অনুক্ষণ।।
যথা দিনে রাতে মিলন–রাসে
চাঁদ হাসে রে চাঁদের পাশে,
যার পথের ধূলায় ছড়িয়ে আছে শ্রীহরি–চন্দন।।
যথা কৃষ্ণ–নামের ঢেউ ওঠে রে সুনীল যমুনায়,
যার তমাল–বনে আজো মধুর কানুর নূপুর শোনা যায়।
আজো যাহার কদম ডালে
বেণু বাজে সাঁঝ–সকালে,
নিত্য লীলা করে যথা মদন–মোহন।।

জগতের নাথ কর পার হে

জগতের নাথ কর পার হে,
মায়া-তরঙ্গে টলমল তরণী
অকুল ভব পারাবার হে।

নাহি কাণ্ডারী, ভাঙা মোর তরী
আশা নাই কূলে উঠিবার,
আমি গুণহীন ব’লে করো যদি হেলা
শরণ লইব তবে কার, বলো কার হে।

সংসারের এই ঘোর পাথারে
ছিল যারা প্রিয় সাথী,
একে একে তারা ছাড়িয়া গেল, হায়
ঘনাইল যেই দুখ-রাতি।

ধ্রুবতারা হয়ে তুমি জ্বালো
অসীম আঁধারে প্রভু আশার আলো,
তোমার করুণা বিনা, হে দীনবন্ধু
পারের আশা নাহি আর।

জাগো জাগো শঙ্খ চক্র

জাগো জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী,
জাগো শ্রীকৃষ্ণ, কৃষ্ণাতিথি তিমির-অপসারী
জাগো জাগো শঙ্খ চক্র গদাপদ্মধারী।

ডাকে বসুদেব দেবকী ডাকে
ঘরে ঘরে নারায়ণ তোমাকে,
ডাকে বলরাম, শ্রীরাম সুদাম
ডাকিছে যমুনাবারি,
জাগো জাগো শঙ্খ চক্র গদাপদ্মধারী।

হরি হে তোমায় সজল নেত্রে
ডাকে পান্ডব কুরুক্ষেত্রে,
দুঃশাসন-সভায় দ্রৌপদী
ডাকিছে লজ্জাহারী।
মহাভারতের হে মহাদেবতা
জাগো জাগো আনো আলোর বারতা,
ডাকিছে গীতা শ্লোক-অনাগতা
বিশ্বের নরনারী,
জাগো জাগো শঙ্খ চক্র গদাপদ্মধারী।

ফুটিল মানস

ফুটিল মানস মাধবী কুঞ্জে,
প্রেম কুসুম পুঞ্জে-পুঞ্জে,
মাধব তুমি এস হে
হে মধু পিয়াসী, চপল মধুপ,
হৃদে এস, হৃদয় এসে হে
নীল মাধব তুমি এস হে।

তুমি আসিলে না বলি শ্যামরাই
অভিমানে ফুল লুটায় ধুলায়,
মাধব তুমি এস হে,
নীল মাধব তুমি এস হে,
বনমালী বোনে বনফুলহার
হায় শুকাইয়া যায় আঁখিজলে তার
জিয়াইয়া রাখি কত আর,
বনমালী বোনে বনফুলহার।

এস গোপন পায়ে,
চিতচোর, এস গোপন পায়ে
যেমন নবনী চুরি ক’রে খেতে,
এস শ্যাম সেই গোপন পায়ে,
চিতচোর, এস গোপন পায়ে।

না হয় নুপুর খুলিয়ো,
শ্যামের যমুনার ক্ষীরনীরে,
বাঁশরীর তানে না হয় লহরী না তুলিও,
না হয় নুপুর খুলিয়ো।

যেমন নীরবে ফোটে ফুল,
যেমন নীরবে রেঙে ওঠে
সন্ধ্যাগগন ফুল,
যেমন নীরবে ফোটে ফুল।
এস তেমনি গোপন পায়ে
অনুরাগভাষাহরি চন্দন শুকায়ে যায়
এস গোপন পায়ে,
আর রহিতে নারী, এস হৃষিকেশ শ্যামরাই
এস গোপন পায়ে।

বনে যায় আনন্দ-দুলাল

বনে যায় আনন্দ-দুলাল,
বাজে চরণে নূপুরের রুনুঝুনু তাল
বনে যায়, গোঠে যায়,
ও কি নন্দ-দুলাল, ও কি ছন্দ-দুলাল
ও কি নন্দন-পথ-ভোলা নৃত্য-গোপাল।

বেণু-রবে ধেনুগণ আগে যেতে পিছে চায়
ভক্তের প্রাণ গ’লে উজান বহিয়া যায়,
এলো গোপনে দেখিতে এলো দেবতারি দল (তায়)
হয়ে কদম তমাল, নৃত্য-গোপাল।

ব্রজ-গোপিকার প্রাণ তার চরণে নূপুর
শ্রীমতী রাধিকা তার বাঁশরির সুর,
সে যে ত্রিলোকের স্বামী তাই ত্রিভঙ্গ-রূপ
করে বিশ্বের রাখালি সে চির-রাখাল।

বিজন গোঠে কে রাখাল

বিজন গোঠে কে রাখাল বাজায় বেণু,
আমি সুর শুনে তা’র বাউল হয়ে এনু, গো।

ঐ সুরে পড়ে মনে কোন সুদুর বৃন্দাবনে
যেত নন্দ-দুলাল ব্রজ-গোপাল বাজিয়ে বেণুবনে,
পথে লুটতো কেঁদে গোপবালা, ভুলতো তৃণ-ধেণু গো
কেঁদে ভুলতো তৃণ-ধেণু।

কবে নদীয়াতে গোরা
ও ভাই, ডেকেছিল এমনি সুরে, এমনি পাগল-করা,
কেঁদে ডাকতো বৃথাই শচীমাতা, সাধতো বসুন্ধরা
প্রেমে গ’লে যত নর-নারী যাচতো পদ-রেণু গো,
তারা যাচতো পদ-রেণু।

ব্রজ–গোপী খেলে হোরি

ব্রজ–গোপী খেলে হোরি
খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে।

পিরীতি–ফাগ মাখা গোরীর সঙ্গে
হোরি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে,
বসন্তে এ কোন্ কিশোর দুরন্ত
রাধারে জিনিতে এলো পিচ্‌কারি হাতে।

গোপীনিরা হানে অপাঙ্গ খর শর ভ্রুকুটি ভঙ্গ
অনঙ্গ আবেশে জর জর থর থর শ্যামের অঙ্গ।

শ্যামল তনুতে হরিত কুঞ্জে
অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে,
রঙ–পিয়াসি মন ভ্রমর গুঞ্জে
ঢালো আরো ঢালো রঙ প্রেম–যমুনাতে।

মম মধুর মিনতি

মম মধুর মিনতি শোন ঘনশ্যাম গিরিধারী,
কৃষ্ণমুরারী, আনন্দ ব্রজে তব সাথে মুরারি।।
যেন নিশিদিন মুরলী-ধ্বনি শুনি
উজান বহে প্রেম-যমুনারি বারি
নূপুর হয়ে যেন হে বনচারী
চরণ জড়ায়ে ধরে কাঁদিতে পারি।।

শ্যামসুন্দর গিরিধারী

শ্যামসুন্দর গিরিধারী
মানস-মধুবনে মধুমাধবী সুরে,
মূরলী বাজাও বনচারী।

মধুরাতে হে হৃদয়েশ
মাধবী চাঁদ হয়ে এস,
হৃদয়ে তুলিও ভাবেরই উজান
রস যমুনা বিহারী।

অন্তর-মন্দিরে প্রীতি-ফুলশয্যায়
বিলাস করো লীলা বিলাসী,
আঁখির প্রদীপ জ্বালি
শিয়রে জাগিয়া রব,
শ্যাম তব রূপ পিয়াসী।

কত সাধ আশা গেল ঝরিয়া
পরো তাই গলে মালা করিয়া,
নূপুর হইব তব চরণে
গাঁথি মম নয়নের বারি ।

সখী আমি না হয়

সখী আমি না হয় মান করেছিনু
তোরা তো সকলে ছিলি,
ফিরে গেল হরি, তোরা পায়ে ধরি
কেন নাহি ফিরায়িলি?

তাঁরে ফিরায়ে যে পায়ে ধরি
ফিরায়ে যে পায়ে ধরি,
তার পায়ে-পায়ে ফেরেন হরি।
করি হরি মান অভিমান তারে,
কেন নাহি ফিরায়িলি।

সখী, তোরা তো হরির স্বভাব জানিস
তাঁর স্বভাবের চেয়ে পরভাব বেশি,
তোরা তো হরির স্বভাব জানিস।
তাঁর স্বভাব জেনেও রহিলি স্বভাবে
ডাকলিনা পরবোধে,
তোদের পরম পুরুষ পরবোধ হলো
ডাকলি না পরবোধে।
তারে প্রবোধ কেন দিলি নে সই
তোরা তো চিনিস হরিরে,
ডাকলি না পরবোধে।

হরি প্রহরী হইয়া রহিত রাধার
ঈষৎ অনুরোধে,
তারে অনুরোধ কেন করলি নে সই,
ডাকলি না পরবোধে।
সখী, তোরা তো রাধার অনুবর্তিনী
তোরা যে রাধার অনুরাধা,
ডাকলি না পরবোধে।

সখী সাজায়ে রাখ লো

সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্প-বাসর
তেমনি করিয়া তোরা,
কে জানে কখন আসিবে ফিরিয়া
গোপিনীর মনচোরা।

সে কি ভুলিয়া থাকিতে পারে,
তার চিরদাসী রাধিকারে,
কত ঝড়-ঝঞ্ঝায়-বাদল-নিশীথে
এসেছে সে অভিসারে।

সখী, বন হতে তুলে আন আধ-ফোটা বনফুল
পাপিয়ার কলতানে ভাসিবে ব্রজকুল,
চাঁপার কণিকা এনে নূপুর বেঁধে রাখ
তেমনি তমাল ডালে ঝুলনা বাঁধা থাক।

বেঁধে রাখ লো, ঝুলনা তেমনি,
বেঁধে রাখ লো।

সখী যোগিনীর বেশ ছাড়িয়া আবার ধরিব নীলাম্বরী
মথুরা ত্যাজিয়া, ব্রজে কি আবার আসিবে কিশোর হরি?
ফিরে আসবে কিশোর নটবর, ফিরে আসবে
হরিপদ রসলোভী নিরানন্দ ব্রজকুল আনন্দে ভাসবে।

সখী সে হরি কেমন বল

সখী সে হরি কেমন বল,
নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে
চোখে আনে এত জল।

সে কি আসে এই পৃথিবীতে
গাহি রাধা নাম বাঁশুরিতে,
যার অনুরাগে বিরহ-যমুনা
হয়ে ওঠে চঞ্চল।

তারে কি নামে ডাকিলে আসে
কোন রূপ, কোন গুণ পাইলে সে
রাধাসম ভালোবাসে।

সখী শুনেছি সে নাকি কালো
জ্বালে কেমনে সে এত আলো,
মায়া ভুলাইতে মায়াবী সে নাকি
করে গো মায়ার ছল।

হারিয়ে গেছে ব্রজের কানাই

হারিয়ে গেছে ব্রজের কানাই
দ্বারাবতীর দেশে,
তাই সারা গোকুল কেঁদে আকুল
চোখের জলে ভেসে।

তার হাতে সেথা নাই রে বেনু
সেথা নাই মধুবন, নাই রে ধেনু,
নাই সে বাঁকা শিখিপাখা
শ্যামের চাঁচর কেশে।

তার কোমল অঙ্গে লাগত ব্যথা
রাখলে বুকে করে,
কোন পাষাণ তারে বসিয়েছে রে
সিংহাসনের ‘পরে।

মোদের মদনমোহন শ্যামে
আন ফিরিয়ে ব্রজধামে,
ওরে বৃন্দাবনের গোপালকে কি
মানায় রাজার বেশে।

হে মাধব

হে মাধব, হে মাধব, হে মাধব
তোমারে প্রাণের বেদনা কব,
তোমারি স্মরণ লব।

সুখের সাগরে লহরী সমান
হিল্লোলী ওঠে যেন তব নামগান,
দূঃখে শোকে কাঁদে যবে প্রাণ
যেন নাম না ভুলি তব।

তুমি ছাড়া বিশ্বে কাহার কাছে
এ প্রাণ যেন কিছু নাহি যাচে,
হে মাধব, হে মাধব।

যেন তোমারি অধিক কেহ প্রিয় নাহি হয়
বিশ্বভুবন যেন হেরি তুমি-ময়,
কলঙ্ক-লাঞ্ছনা শত বাধা বয়
তব প্রেমে সকলি সব।

হে গোবিন্দ

হে গোবিন্দ রাখ চরণে
মোরা তব চরণে শরণাগত
তব চরণে শরণাগত,
আশ্রয় দাও আশ্রিতজনে,
হে গোবিন্দ রাখ চরণে।

গঙ্গা ঝরে যে শ্রীচরণ বেয়ে
কেন দু:খ পাই সে চরণ চেয়ে,
এ তৃ-তাপ জ্বালা হর হে শ্রীহরি
চাহ তবে কনক-নয়নে।

ভিক্ষা চাহিলে মানুষ নাহি ফিরায়
তোমার দুয়ারে হাত পাতিল যে,
ফিরাবে কি ফিরাবে কি তুমি তায়?
তব চরণ ধরিয়া ডুবে মরি যদি
রবে কলঙ্ক ভুবনে।

মোরা তব চরণে শরণাগত
আশ্রয় দাও আশ্রিতজনে
হে গোবিন্দ রাখ চরণে।

Share on

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *