প্রতিমা হবে বিসর্জন Lyrics
প্রতিমা হবে বিসর্জন: মরমী সাধক মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের এক কালজয়ী বিচ্ছেদী গান
দুর্গাপূজার শেষ লগ্ন, দশমী। আনন্দ-উৎসবে মা দুর্গার আগমন যেমন বাঙালি মনকে আপ্লুত করে, তেমনি তাঁর বিদায়ের করুণ সুর নিয়ে আসে এক গভীর বিষাদের বার্তা। এই বিসর্জন লগ্নের মর্মস্পর্শী অনুভূতিকে অত্যন্ত সরল কিন্তু গভীর দার্শনিকতার মোড়কে যে গানটি ধারণ করেছে, তা হলো— “প্রতিমা হবে বিসর্জন” (প্রথম কলি: “কৈলাসে ভোলা কাঁদে একেলা”)। মরমী সাধক বাউল কবি মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান রচিত এই গানটি লোকসংগীতের ইতিহাসে এক কালজয়ী সৃষ্টি।
গানটির পরিচিতি
গীতিকবিতার মর্মার্থ ও ভাববস্তু
এই গানটি কেবল প্রতিমা বিসর্জনের বর্ণনা নয়, বরং একটি গভীর আধ্যাত্মিক বিচ্ছেদ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান বাউল দর্শনের মাধ্যমে মা দুর্গা ও তার ভক্তের মধ্যকার প্রেম এবং বিরহকে ফুটিয়ে তুলেছেন:
- শিবের করুণা: গানটি শুরু হয়েছে দেবাদিদেব শিব বা ভোলার (কৈলাসে ভোলা কাঁদে একেলা) গভীর দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে। মা উমা পিত্রালয় ছেড়ে কৈলাসে ফিরে যাচ্ছেন, তাই ভোলার ‘গলার বাঁধন ছিঁড়ে গেছে’ এবং ‘গাথা মালা’ ছিন্ন হয়েছে— যা মূলত এই মিলন-বন্ধনের ক্ষণস্থায়ীতাকে নির্দেশ করে।
- পূজার আয়োজন ও সমাপ্তি: কবি একদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পূজার ধুমধাম ও আড়ম্বরের বর্ণনা দিয়েছেন (‘শত ঢাক বাড়ি, নাড়ু চিড়া মুড়ি’, ‘রঙ তুলিতে তারে করিয়া বরণ’)। অন্যদিকে, দশমীর আগমন সেই সকল উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটায় (‘ছেড়ে গেছে নবমী পড়েছে দশমী’)।
- ভক্তের আকুলতা: সবচেয়ে করুণ চিত্রটি আসে ভক্তের আকুতিতে। যে মাকে সপ্তমী তিথিতে ‘সাদরে চরণে চুম্বন’ করা হয়েছিল, সেই মাকে কীভাবে ‘ফেলে যমুনায়’ কাঁদা যায়? এই প্রশ্নটি ভক্তের হৃদয়ের যন্ত্রণা তুলে ধরে।
- বিদায় লগ্ন: শেষ স্তবকে কবি জানান, ‘নাচানাচি’, ‘আতসবাজি’ ও ‘ঢাকির ঢাকবাজি’ সব শেষ, আজ কেবল ‘বিদায়ী লগন’। খেলা ভেঙে গেছে এবং মাতাল রাজ্জাকের মনও যেনো এক অবলা শিশুর মতো কেঁদে উঠছে— যা মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনে আনন্দের ক্ষণস্থায়ীতার প্রতীক।
গীতিকার পরিচিতি: মরমী সাধক মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান
‘প্রতিমা হবে বিসর্জন’ গানটির গীতিকার মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান (আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান) ছিলেন বাংলাদেশের লোকসংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
- জন্ম ও মৃত্যু: তিনি ১৯৩৩ সালের ২৭শে আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
- উপাধি ও দর্শন: তিনি মূলত ‘মাতাল কবি’ নামেই পরিচিত। তাঁর এই উপাধি মদ্যপানের কারণে নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর প্রেম এবং বাউল সাধনা ও গানে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মত্ত রাখার জীবনধারা থেকে এসেছে।
- গুরু ও ঘরানা: তিনি কেরানীগঞ্জের বামনসুরের সাধক দেওয়ান আব্দুল খালেক-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর গানগুলো দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতা ও মরমী দর্শনের মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ।
- প্রভাব: রাজ্জাক দেওয়ান তাঁর তাৎক্ষণিক যুক্তি খণ্ডনমূলক ‘মালজোড়া’ গানের আসরের জন্য বিশেষভাবে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে খ্যাতিমান শিল্পী মমতাজ বেগম এবং কাজল দেওয়ান অন্যতম।
উপসংহার
মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের ‘প্রতিমা হবে বিসর্জন’ গানটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবের গান নয়, এটি মানবজীবনের গভীর বিচ্ছেদবোধ এবং জাগতিক ক্ষণস্থায়ীতার এক অসাধারণ কাব্যিক দলিল। সহজ ভাষায় রচিত হলেও এর ভাবুকতা গভীর। বছরের পর বছর ধরে, এই গানটি দুর্গাপূজার বিসর্জন লগ্নে বাঙালি হৃদয়ের অব্যক্ত বেদনাকে সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছে।