সাধক রামপ্রসাদ সেন
রামপ্রসাদ সেনঃ
বাঙালি শাক্ত কবি এবং শ্যামাসঙ্গীতের আদিকবি, গায়ক, সুরকার।কবিরঞ্জন নামেও খ্যাত ছিলেন।
১৭২০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের সুবা বাংলার হালি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে এই স্থানটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রদেশের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়, কলকাতা শহরের ২৫ মাইল উত্তরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত। তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে।
রামপ্রসাদের পরিবারের তান্ত্রিক হিসেবে খ্যাতি ছিল। রামপ্রসাদের পিতা রামরাম সেন ছিলেন একজন আয়ুর্বৈদিক চিকিৎসক ও সংস্কৃত পণ্ডিত। রামপ্রসাদের মা সিদ্ধেশ্বরী দেবী ছিলেন রামরাম সেনের দ্বিতীয়া পত্নী।
সেকালের রীতি অনুযায়ী, বাল্যকালে রামপ্রসাদকে একটি সংস্কৃত টোলে শিক্ষালাভের জন্য পাঠানো হয়। এই টোল থেকে ১৬ বয়সের মধ্যেই তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফারসি ও হিন্দি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রামরাম সেন-এর ইচ্ছা ছিল যে, তাঁর পুত্রও পারিবারিক চিকিৎসক বৃত্তি গ্রহণ করুক। কিন্তু রামপ্রসাদের আগ্রহ ছিল আধ্যাত্মিক জীবনযাপনে। তাঁর ১৬ বৎসর বয়সে পিতার মৃত্যু হয়। এরপর ১৭-১৮ বৎসর বয়সে জীবিকার জন্য কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র নামক একজন ধনাঢ্য ব্যাক্তির কাছাড়িতে মুহুরির চাকরি নেন। এই সময় তাঁর বেতন ছিল মাসিক ত্রিশ টাকা।
চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তিনি শ্যামাবিষয়ক গান বা কবিতা রচনা করতেন। কথিত আছে, তিনি প্রায়ই কাছারির হিসাবের খাতায় শ্যামসঙ্গীত লিখতেন। এ বিষয়ে অন্যান্য কর্মচারীরা তাঁদের মালিকের কাছে রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান। দুর্গাচরণ মিত্র এই বষয়ে তদন্ত করতে এসে গানগুলি পড়েন এবং রামপ্রসাদের কবিত্বশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কেরানির কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে স্বগ্রামে প্রেরণ করেন। এই সময় দুর্গাচরণ তাঁর মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন।
গ্রামে ফিরে তিনি কঠোরভাবে আধ্যাত্মিক বিষয় ও সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন হন। এই সাধনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তিনি যাতে ভবিষ্যতে সংসার বিবাগী হয়ে সন্ন্যাসী না হয়ে যান, সে জন্য তাঁর পরিবারের লোকেরা সর্বাণী নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। বিবাহের পর পারিবারিক প্রথানুযায়ী নবদম্পতি কুলগুরু মাধবাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। কথিত আছে, দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু তাঁর কানে মন্ত্রপ্রদান করলে তিনি দেবী কালীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এক বছর পর তাঁর গুরুর মৃত্যু হয়। এরপর রামপ্রসাদ তান্ত্রিক যোগী ও পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গদেশে কালী আরাধনার প্রবর্তক এবং সুপ্রসিদ্ধ শাক্ত তন্ত্রগ্রন্থ তন্ত্রসারের রচয়িতা। আগমবাগীশ রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনা ও কালীপূজার পদ্ধতি শিক্ষা দেন।
বিবাহের পরও তাঁর সাধনা অব্যাহত ছিল। জানা যায়, এই সময় তিনি আকণ্ঠ গঙ্গাজলে নিমজ্জিত অবস্থায় শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। এই সময় তিনি তান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী, এক পঞ্চবটীর (বট, বেল, আমলকি, অশোক ও অশ্বত্থ গাছের সম্মিলিত রূপ) তলায় সাধনা করতেন। তাঁর আসন ছিল পঞ্চমুণ্ডী (সাপ, ব্যাঙ, খরগোশ, শৃগাল ও মানুষের করোটীর দ্বারা সৃষ্ট আসন)। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস ছিল যে,তিনি এই সাধনার মধ্য দিয়ে আদ্যাশক্তি মহামায়া দর্শন পেয়েছিলেন।
এর পাশাপাশি তাঁর শ্যামাসঙ্গীত রচনা অব্যাহত ছিল। তিনি মাঝে মাঝে এই গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি নিজেও কালীভক্ত ছিলেন। তাই তিনি রামপ্রসাদকে তিনি সভাকবির মর্যাদা দেন। কিন্তু রামপ্রসাদ মহারাজের রাজসভায় বিশেষ আসতেন না। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে প্রায় ১০০ একর নিষ্কর জমি প্রদান করেন। পরে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রামপ্রসাদ তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্য কৃষ্ণচন্দ্রকে উৎসর্গ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র এই সময় রামপ্রসাদকে কবিরঞ্জন উপাধিও প্রদান করেছিলেন। কথিত আছে, মহারাজের অন্তিম সময়ে রামপ্রসাদ তাঁর পাশে থেকে তাঁকে কালীর নামগান শুনিয়েছিলেন। অনেকের মতে, নবাব সিরাজদ্দৌলা-সহ বহু সুফি সন্তেরাও রামপ্রসাদের আধ্যাত্মিক সংগীতে মুগ্ধ হন। নবাবের অনুরোধে রামপ্রসাদ একবার তাঁর সভাতেও গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
বৃদ্ধ বয়সে রামপ্রসাদের দেখাশোনা ভার নিয়েছিলেন তাঁর পুত্র রামদুলাল ও পুত্রবধূ ভগবতী। রামপ্রসাদের মৃত্যু নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। রামপ্রসাদ প্রতি বছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজা করতেন। একবার সারারাত পূজা ও গানের পর সকালে কালীপ্রতিমা মাথায় করে নিয়ে বিসর্জনের পথে বের হন তিনি। ভক্তরা তাঁর পিছন পিছন বিসর্জন শোভাযাত্রায় অংশ নেন। স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে তিনি গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জনার্থে অবগাহন করেন । প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল আনুমানিক ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।
রামপ্রসাদ সম্পর্কে কিংবদন্তি
রামপ্রসাদের কালীভক্তি নিয়ে নানারকম গল্প আছে।যেমন−
১. রামপ্রসাদ একবার বাড়ির একটি বেড়া বাঁধার সময়,তাঁর কন্যাকে বেড়ার ওপারে থেকে দড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রেখেছিলেন।তাঁর এই কন্যা ওপার থেকে পালালে,রামপ্রসাদের কন্যা জগদীশ্বরীর রূপে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। রামপ্রসাদ পরে বুঝতে পারেন যে, তাঁর ইষ্টদেবীই কন্যার বেশে এসে তাঁকে সাহায্য করেন। রামপ্রসাদের একটি গানে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
নয়ন থাকতে দেখলে না মন,
কেমন তোমার কপাল পোড়া।
মা ভক্তে ছলিতে তনয়ারূপেতে,
বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া॥
[মন কেন মায়ের চরণছাড়া।গান-৮]
২. বারাণসী যাত্রাকালে রামপ্রসাদের দেবী অন্নপূর্ণার দর্শন লাভ করেন। একবার তিনি গঙ্গাস্নান সেরে নিত্যপূজার কাজে চলেছেন, এমন সময় একটি সুন্দরী মেয়ে তাঁর কাছে গান শোনার আবদার ধরে। পূজার দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে রামপ্রসাদ মেয়েটিকে একটু অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু পরে ফিরে এসে তাকে আর দেখতে পান না। পরে তিনি ধ্যানের ভিতর দেবী জানান, “আমি অন্নপূর্ণা,আমি বারাণসী থেকে তোর গান শুনতে এসেছিলাম। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।”এরপর রামপ্রসাদ নিজের উপর ক্রুদ্ধ হন। তখনই দেবী অন্নপূর্ণাকে গান শোনাবার জন্য কাশীধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ত্রিবেণী সংগমে এসে পুনরায় দেবীর কণ্ঠে তিনি শুনতে পান, “এখানেই আমাকে গান শোনা। বারাণসীই আমার একমাত্র নিবাস নয়, আমি সমগ্র জগৎ চরাচরে অবস্থান করি।”
রামপ্রসাদী সুরঃ
তিনিই বাংলায় ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম ও দেবী কালীর লীলাকীর্তন শ্যামাসংগীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। রামপ্রসাদ সেনই প্রথম ভক্তিসহকারে দেবী কালীর লীলাকীর্তন গান রচনা করেন। তাঁর গানেই প্রথম কালীকে স্নেহময়ী মাতা এমনকি ছোটো মেয়ের রূপেও দেখা যায়। কীর্তন ও বাংলার লোকসঙ্গীত ধারার বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে রামপ্রসাদ বাংলা সংগীতে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন। এই সুরের ধারার নাম হয়ে যায় রামপ্রসাদী সুর। এই ধারায় সংগীতরচনাকারী তাঁর দুই বিশিষ্ট উত্তরসূরি হলেন কমলাকান্ত ও মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
রামপ্রসাদের রচনাবলিঃ
১. বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল
২. কালীকীর্তন।
৩. কৃষ্ণকীর্তন নামক অসম্পূর্ণ খণ্ডকাব্য ও শক্তিগীতি।
৪. কালীকীর্তন
৫. কৃষ্ণকীর্তন অসম্পূর্ণ রচনা।
৬. বিদ্যাসুন্দর